পুরোটাই আবোলতাবোল….

Posted: August 22, 2010 in যত্তসব হাবিজাবি

৯২ বা ৯৩ সালের কথা, বাবা তখন সাতক্ষীরাতে। মায়ের চাকরির সুবাদে আমি আর মা তখন ঝালকাঠীতে থাকতাম। বাবা হয়তো মাসে একবার করে আসতো। এলে খুব মজাই হতো। ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে সম্পর্কটা বন্ধুর মতোই। যাই হোক, যত কথাই হোক তার সাথে শেয়ার করা চাই। একবার সাতক্ষীরা থেকে ফেরার সময় বাবা একটা ইয়াশিকা ক্যামেরা নিয়ে হাজির। ক্যামেরা হাতে পেয়ে আমার তো মহানন্দ। অবশ্য এর আগে কখনো ক্যামেরা হাতে নিয়েছি বলে মনে পড়ে না। যাক, এবার ছবি তোলার পালা…প্রথম দিকের কটা ছবি বাবা নিজেই তুলতো। এরপরে ক্যামেরা এলো আমার হাতে। দেখিয়ে দেয়া হল কি করে ফাইন্ডার দিয়ে কাউকে দেখে ফ্রেমে আটকাতে হয়। জীবনে প্রথমবার ছবি তুলতে যাছি , একে তো চরম উত্তেজনা কাজ করছে অন্য দিকে ভয় করছে …যদি ক্যামেরা হাত থেকে পড়ে যায়..?? তবুও সেই কাঁপা কাঁপা হাতেই শাটার টিপতে পেরেছিলাম। এখনো মনে আছে প্রথম ছবিটা বাবা’র-ই তুলেছিলাম।

ফিল্ম কিনতে হতো বলে খুব প্রয়োজন ছাড়া ক্যামেরা বের করা হত না। তাই বেশীরভাগ সময়েই ক্যামেরাটা পড়েই থকতো। এখনো পড়ে আছে। তবে সেই সময়ের হাতে গোনা কয়েকটা ছবি তোলার পরেই কেমন করে জানি ছবি তোলার প্রতি আলাদা একটা ভালোলাগা জন্ম নেয়। কিন্তু হাতে ক্যামেরা না থাকায় বসে বসে আঙুল চোষা ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না।এরপরে চলে গেছে অনেকটা সময়….বলতে গেলে বেশ কয়েকটা বছর।

কি আর করা….কাজ কারবার তো কিছু একটা করা লাগবে। ব্যাস….হাতের কাছে থাকা পেন্সিল দিয়েই খাতায় আঁকিবুকি কাটা শুরু করি।পেন্সিল দিয়েই কাজ চালাতে থাকি….রঙের কোন ব্যবস্থা নাই। আর…এমনও একটা জায়গায় থাকতাম ঐ আটা ময়দার দোকান ছাড়া আর কিচ্ছু ছিলো না। আর সেখানে ছবি আঁকার জল রঙের কথা..??? ভাবা যায় না….

যাক, শেষ পর্যন্ত সেই আব্বাজানই রঙের ব্যবস্থা করে দিলো…. যাক বাবা…বাঁচা গেলো। এইবার মনের খায়েশ মিটিয়ে কাকের ঠ্যাং , বকের ঠ্যাং আঁকা যাবে….. হলও তাই….আঁকতে থাকি যখন যা মনে চায়। একদিন সাহস করে স্কুলের ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়ে বসলাম। ওমা….প্রতিযোগিতা শেষে কপালে দেখি একটা পুরস্কারও জুটে গেলো। আহা…আমাকে আর পায় কে। সাহস বেড়ে গেলো। সুযোগ পেলেই প্রতিযোগিতায় নাম লেখাই….টুকটাক পুরস্কারও কপালে জুটতে থাকে। এইভাবেই কাটিয়ে দিলাম প্রাইমারি স্কুলের বছরগুলো।

হাই স্কুলে ভর্তি হবার পর থেকেই সাধের শখে কেন জানি ভাটা পড়তে শুরু করে। ছবি আঁকা চলে ….কিন্তু একটু ভিন্ন স্টাইলে। রং-তুলি বাদ……ধরলাম আবার পেন্সিল। শুরু করলাম নকল করা…..আরে না….পরীক্ষার খাতায় না। খবরের কাগজে কার্টুন দেখে সেগুলো নকল করতে শুরু করলাম। টানা ক্লাশ টেন পর্যন্ত এই নকলবাজি নামক কু-কামটা করেছি।সাথে অবশ্য পড়ালেখায় ফাঁকিবাজিটাও ধুমছে চলেছে……মজাটা টেরও পেলাম এসএসসির রেজাল্ট হাতে পেয়ে। যাই হোক….পুরান দুঃখ নাই বা ঘাটলাম।

এসএসসি পরীক্ষার কিছুদিন আগে হঠাৎ কি করে যেন আবার ছবি তোলার ভূতটা মাথায় ভর করলো। ক্যামেরাটা নিয়ে আমি আর শাহীন বেরিয়ে পরলাম কিছু অখাদ্য ফটোগ্রাফি নামক কুকর্ম করার প্রত্যয়ে। ছবিগুলো সব তুলেছিলামও বেশ। কড়া দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে ছবি তোলা হলো। ছবি তোলা নিয়ে সে সময়ে কত গবেষণা। এভাবে না সেভাবে, ওভাবে না এভাবে। সকল গবেষণামূলক ছবির চূড়ান্ত রিপোর্ট  পেলাম ছবির প্রিন্ট আউট কপি হাতে আসার পরে। আহা….কি মারাত্মক সব ছবি…!! কি তুলেছি ছবি দেখে নিজেরাই চিনতে পারি না। স্মৃতিচারণ করে সব বের করা লাগে। ছবি দেখে তো পুরাই হতাশ। কি আর করা…. নতুন করে আর একদফা গবেষণা শুরু করবো তারো উপায় নেই। ওই ছবি দেখিয়ে বাপের কাছে আবার ফিল্ম কেনার টাকা চাইলে নির্ঘাত ঠ্যাং ভেঙে দিতো। তাই ডরেও আর ফটোগ্রাফির নাম মুখে আনি নাই।

কি আর করি …এই দুঃখ নিয়াই বাসা ছাড়লাম। মানে….ইন্টার লাইফে ঠাঁই হল বড় মামা’র বাসায়…বরিশালে। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। যে লোকটারে দেখলে ডর-ভয়ে সারা শরীরে ভাইব্রেশন শুরু হয়ে যেতো তার সাথে তার বাসাতেই কিনা আমাকে থাকতে হবে…??? খাইছে আমারে…. নাক চোখ বুঁজে   উঠলাম মামুর বাসায়। যাওয়ার পরপরই তিনি নিষেধাজ্ঞামূলক বিশাল এক সংবিধান আওড়ালেন। আমি খালি একের পরে এক মাথা নেড়ে যাচ্ছিলাম।  আর মনে মনে বলছিলাম……এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচি। কিন্তু হায়….উপায় নাই। বাধ্য হয়ে মুখে কুলুপ এঁটে আজরাইলের সাথে থাকতে হল দুই দুইটা বছর। তবে কপাল একদিক থেকে ভালো ছিলো যে, মামী ছিলো মামার ঠিক উল্টো।

তবে মামার সাথে একটা দিকে আমার মিল ছিল। তেনারও ছবি তোলার ব্যাপারে বিয়াপর দূর্বলতা ছিলো। আর সেই দূর্বলতার ঠ্যালায় অস্ট্রেলিয়া থেকে আনালেন সনি সাইবার শটের ৪.১ মেগাপিক্সেলের একখান কম্পেক্ট ক্যামেরা।ছোটবেলা থেকেই আমার একটা স্বভাব ছিলো অন্যের কোন জিনিস ব্যবহার করতে পারতাম না। তাই সহজে কারো জিনিসে হাতও দিতাম না। কিন্তু এবার সেই স্বভাবের কিছুটা ছন্দপতন ঘটলো…..মাঝে মাঝে ক্যামেরাটা ধরতাম। কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে টুক-টাক ছবি তুলতে দিতেন। (এখানে একটা কথা বলে রাখি, মামা আবার আমাদের কলেজের ফিজিক্স বিষয়ক পন্ডিত ছিলেন।) যেদিন ছবিগুলোর প্রিন্ট আনতেন সেদিন বুঝতাম আজ আমার কপালে খারাপই আছে। রাতে সব ছবি এক জায়গায় মেলে ধরে আমাকে ডাকতেন আর, বেশ কড়া ভাষায় আমার তোলা প্রত্যেকটা ছবির সমালোচনা করতেন। এই ছবিটা আরো একটু কেন ডানে বামে সরালাম না, কেন অমুকের অর্ধেক অংশ আসলো, কেন আলোর দিকে নজর দিলাম না….এইসব আর কি… (এ নিয়ে মনে মনে থকন অনেক রাগ করলেও, এখন বুঝি ওই গালি পরে অনেক কাজে দিয়েছে…..গালি দেয়ার জন্য থ্যাংক্স টু মামু) ।

যেভাবেই হোক কোন মতে এভাবে নাক চোখ বুজে দুইটা বছর পার করলাম। এবার ঢাকা সফরের পালা। যাও কোচিং-এ…… আরে বাবা, কোচিং করে কি হবে …. হয় কোন বেসরকারী ভার্সিটিতে EEE-তে ভর্তি হবো নতুবা চারুকলায় একটা চেষ্টা চালাবো। এই ছিলো মনে ধান্দা….. যাই হোক….., ঢাকা শহর, সম্পূর্ণ অচেনা অজানা। তখন তেমন কেউ পরিচিতও নেই যে তার কাছে যাবো। খালামনি ঢাকা থাকলেও তাকে জানানো হয়নি যে আমি ঢাকাতে। পরে তিনিই কিভাবে যেন আমাকে খুঁজে বের করলো। যাকগে…সে অন্য কথা….

ঢাকা আসার পরে কপালে পাকাপাকি ভাবে একটা মোবাইল ফোন জোটে। তাও আবার ক্যামেরাওয়ালা  ফোন….(অবশ্য ভিজিএ ক্যামেরা ছিলো)। হোক না ক্যামেরার মান খারাপ তাতে কি …??? আমার ক্যামেরা হলেই হল। সে যত নিম্নমানেরই হোক না কেন…। আমাদের রুমে তখন থাকতো গৌতম দা। ইটিভিতে ইএনজি ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করতো। যাক…. এতোদিনে মনেরমত একজনকে পাওয়া গেল। কিন্তু লোক পাওয়া গেলে কি হবে….তাকে হাতের কাছে তো পেতে হবে… ও ব্যাটা তো সারাদিনই ব্যস্ত থাকতো। তাই তার কাছে আর আমার দীক্ষাগ্রহণ হয় না। কি করি….. গৌতম দা’র রুমে ফটোগ্রাফির উপর কিছু বই ছিলো, তাই বসে বসে ঘাটতে লাগলাম। আমার আবার একটা বিশ্রী রোগ আছে। কোন জায়গাতে ছয় মাসের বেশী মন টেকে না। কিন্তু এই উত্তরায় যে কোন মধু পাইছি কে জানে। প্রায় দু’ বছর হতে চললো এখনো নড়ার কোন নাম গন্ধ নাই..!! সত্যিই নিজের কাছে এটা অবাকই লাগে…..

তো….ওই খান্দানি ভিজিএ ক্যামেরা দিয়েই আমি আমার ফটোগ্রাফি নামক কু-কর্ম করতে থাকি। অন্যদিকে গ্রাফিক্স ডিজাইনিং এর উপর আট মাসের একটা কোর্স করা ছিলো বলে , ক্যামেরায় ওঠা অখাদ্য মার্কা সব ছবি আর ফটোশপ নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে থাকি। মাঝে মাঝে দু’ একটা ভালো কিছু  বেড়িয়ে আসতে থাকে…..দেখে মনে একটু হলেও শান্তি পাই, চেষ্টা চালাতে থাকি আরো ভালো কিছু কি করে করা যায়। এর মাঝেই আবার ফোন সেট বদল করি….এবারের ক্যামেরাটা কিছুটা ভালো। আর আমিও…..মন ভরে ছবি তুলতে থাকি। আর তোলার পরে সবকটা ছবিকে কান ধরে পাঠিয়ে দেই ফটোশপ নামক গবেষণাগারে। ছবির ঘষা মাজা, কাটা-ছেঁড়া সব ওখানেই চলে।

এইতো এভাবেই চলছে আমার ছবি তোলার নেশা। যতদিন পারবো ততদিন এ নেশা ধরে রাখবো। নিজের জন্য এখনো একটা ক্যামেরার ব্যবস্থা করতে পারি নি। কবে পারবো তাও জানি না। বাসায়ও বলতে পারছি না। কারণ….বললে খবর আছে। তবুও স্বপ্ন দেখি নিজের মনের মত একটা ক্যামেরা থাকবে। তবে কখনো স্বপ্ন দেখি না বড় মাপের কোন ফটোগ্রাফার হয়ে যাবো….তেমনটা হবার কোন ইচ্ছেও নেই। শুধু নিজের আত্মার খোরাকটুকু জোগার করতে পারলেই হলো। আর কিচ্ছু চাই না…..

Comments
  1. Shaheen says:

    কি লিখলিরে অনেক কিছু মনে পড়ে গেল

  2. shahnaj daffodil says:

    hmm………………..nostalgic…………..vlo likheco.lekhar vetor notun je sei sad ta ace…keep it up.

Leave a reply to মেঘ রোদ্দুর Cancel reply